নির্মল কর মংগল করে মলিন মর্ম ঘুচায়ে : ডা. মালিহা পারভীন
 প্রকাশিত: 
 ২৩ জুন ২০২০ ২১:২৭
 আপডেট:
 ৬ আগস্ট ২০২০ ০৬:১৫
                                
হাত ধোঁয়ার কথা বারবার বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হিসেবে। কিন্তু ১৮৪০ সালে হাংগেরিয়ান বিজ্ঞানি ড: ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ প্রথম অনুধাবন করেছিলেন হাত ধোঁয়ার সাথে রোগ সংক্রমন ও মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক।
বিশ্বের কোটি মানুষকে অনিবার্য মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে দেয়ার ফল হিসেবে সেই ডাক্তারকে পাগলা গারদে যেতে হয়েছিল চক্রান্তের শিকার হয়ে। পরবর্তীতে সেখানকার গার্ডরা পিটিয়ে তাকে খুন করে।
২০২০ - ১৫ ই জুন। বাংলাদেশে ডা: রাকিবকেও পৈশাচিক হামলার শিকার হতে হয়েছে রোগীর স্বজনদের হাতে। এই ডাক্তারের অপরাধ ছিল এই করোনা মহামারিতে জীবন তুচ্ছ ক'রে গ্রাম্য দাইয়ের অপচিকিৎসার শিকার মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচানোর চেস্টা করেছিলেন। পরবর্তিতে জটিলতা দেখা দিলে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন ঢাকায় পাঠানো হয় পথিমধ্যে সে মারা যায়। ক্রুদ্ধ রোগীর স্বজনরা পরে ডা: রাকিবকে আঘাত করলে মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয়ে তার মৃত্যু হয়। পরোপকারি এই চিকিৎসক ' গরিবের ডাক্তার ' হিসাবে তার এলাকা খুলনা ও বাগেরহাটে পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন।
১৮৪০ থেকে ২০২০।। না, প্রেক্ষাপট যাই হউক -- অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো আজো ঘটছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই স্বাস্থ্যকর্মিরা শুধু নয় সব ধরনের পেশাজীবীই এমন সহিংসতার শিকার হয়েছে যুগে যুগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিবছর ৮% থেকে ৩৮% চিকিৎসা সেবাকর্মী শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন প্রতি।
জ্ঞানে - বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, উন্নতিতে পৃথিবী, সভ্যতা ও সমাজ এগিয়েছে অনেক। কিন্তু কিছু মানুষের অন্তর্গত ক্রোধ, অন্ধত্ব, পৈশাচিকতা মানুষকে করে অমানবিক। তাই হয়তো প্রান দিতে হয় ডা : রাকিবকে, ডা: রওশন আরাকে যিনি ২০০৯ সালে কর্মস্থলে বখাটের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছিল। এ ছাড়াও শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন আছেই। বাংলাদেশে তাই ' চিকিৎসক সুরক্ষা আইন ' এখন সময়ের দাবি।

চিকিৎসকদের সুরক্ষায় ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাস্ট্রে, আস্ট্রেলিয়া, চীন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রশাসনিক ও আইনগত নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যেমন ভারতে ২০০৮ সাল থেকে মোট ১৮ প্রদেশে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা সম্পর্কিত আইন পাস করা হয়। ‘ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনা হলেই চিকিৎসককে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার নয়’- এ মর্মে ভারতের সুপ্রীমকোর্ট একাধিক নির্দেশনা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ১৯৯৯ সালে স্বাস্থ্য খাতে হামলা রোধে ‘জিরো টলারেন্স জোন ক্যাম্পেন’ চালু করেছে।
বাংলাদেশের চিকিৎসকগন বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে জনগনকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে আসছে। নিজেকে ও পরিবারকে মৃত্যু ঝুঁকিতে রেখে তারা অক্লান্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তাই জনগন ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব তাদের কাজের যথাযথ মুল্যায়ন করা, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করা, উৎসাহিত করা।
এই ২০২০ এর করোনাক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশত প্রথিতযশা চিকিৎসক। এদের অনেকের মৃত্যুর জন্যও কিন্তু পরোক্ষ ভাবে অব্যবস্থাই দায়ি। অসচেতন জনগন স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় সংক্রমনের সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। অন্যদিকে নকল মাস্ক, নকল ওশুধ, নকল সুরক্ষা সামগ্রি সরবরাহ করে সম্মুখ যোদ্ধাদেরকে প্রানকে ঝুঁকিপুর্ন করা হয়েছে। অপ্রতুল অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মি, বিকল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতির জন্য অনেকসময় উপযুক্ত স্বাস্থ্য' সেবা দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল যেমন হারিয়ে যায় তেমনি তাদের প্রতি জনগনের অনাস্থা তৈরি হয়।

আজকাল মেধাবী প্রজন্ম এই মহান পেশার প্রতি সম্মান বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কেউ আর ডাক্তার হতে চাইছে না। তাই দরকার সার্বিক সামাজিক দৃস্টিভংগির পরিবর্তন। নানা গল্প উপন্যাস, সিনেমা, গানে চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশাকে যেমন সেবা ও সম্মানজনক হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। আবার তেমনি অনেক নেতিবাচক দিকও অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা ধরেছে। যা মোটেও কাম্য নয়।
' সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, ক্ষিধে পেলে পানি খায় চিবিয়ে --' এখানে ডাক্তারকে হাস্যকর কাল্পনিক চরিত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। ছোটবেলায় পড়া ' ডাক্তার আসিবার পুর্বেই রোগী মারা গেল ' -। এটা পড়ে মনেই হবে ডাক্তার মানেই দায়িত্বহীন কেউ। উত্তম সুচিত্রার বাংলা সিনেমায় বোঝানো হয়েছে ডাক্তার মানেই বিনে পয়সার সেবক যা বাস্তবতা বিবর্জিত। হালে আবার নচিকেতার গানে ডাক্তারকে অর্থলোভীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আর যদি ডাক্তারদের উপর এমন অন্যায় হামলা বা বঞ্চনার ঘটনা ঘটে তাহলে মেধাবিরা কেউ এ পেশায় আসতে চাইবে না। জনগন হবে অপচিকিৎসার শিকার।
সমাজের সবচেয়ে মেধাবি জনগোষ্ঠী এই চিকিৎসক সমাজ। অনেক শ্রম, জীবনের মুল্যবান সময় ডাক্তার হওয়া যায়। বাংলা সিনেমায় যেমন দেখানো হয় ডাক্তার নায়িকার হাত দেখেই বলে দিল ' আপনি মা হতে চলেছেন --' - ডাক্তারি বিদ্যা এতো সহজও নয়। প্রায় সব মা বাবারই স্বপ্ন থাকে তার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার হউক। কিন্তু যোগ্যতা না থাকলে ইচ্ছে করলেও সবাই তা হতে পারবে না।
একজন ডাক্তারের অবদান পৃথিবীর সব দেশে সব সমাজে অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বৈরাচারি আন্দোলন, করোনা আন্দোলন - এমন বহু ইতিহাসের সাথে আছে এদেশের চিকিৎসক সমাজের প্রত্যক্ষ সংপৃক্ততা, মহান আত্মত্যাগ। একজন ডাক্তার সম্পুর্ন শ্রম, মেধা, ভালবাসা যত্ন দিয়ে রোগীকে সুস্থ করার চেস্টা করেন। বেশির ভাগ রোগীরাও চিকিৎসককে শ্রদ্ধায়, নির্ভরতায় দেবতার আসনে বসান।
রকজন মানুষের জন্ম সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা, মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরও প্রয়োজন একজন চিকিৎসককে। তাই চলুন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা চিকিৎসা যোদ্ধাদের সম্মানজনক ভাবে উপস্থাপন করেন। জীবনে, সমাজে তাঁদের গুরুত্ব ও প্রয়োজন অনুধাবন করি। তাদের উজ্জ্বল কীর্তি তুলে ধরি। শিশুদের মনে স্বপ্ন বুনে দেই বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হবার, একজন দক্ষ চিকিৎসক হবার। কেননা ১৮ কোটি মানুষের দেশে আরো বহু সংখ্যক চিকিৎসকের।
মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন দেশ স্বাধীন করার জন্য। আর একজন ডাক্তার যুদ্ধ করে যান মানুষকে বাঁচাতে। তাই এই মহতী জনগোষ্ঠীকে উপস্থাপন করতে হবে দেশের অত্যাবশ্যক সম্পদ হিসাবে। মেধাবি, সৎ, পরিশ্রমী ও মানবিক হিসাবে।
সন্তানের কাছে দেশের ডাক্তারদের সফলতার গল্প বলতে হবে। গুলিবিদ্ধ মা ও তার পেটের বাচ্চাকে বাঁচানোর গল্প, সফল অপারেশনে জোড়া বাচ্চা আলাদা করার গল্প, লিভার ও বোনমেরো প্রতিস্থাপনের মতন জটিল চিকিৎসার সফল গল্প। ওর স্যালাইন, করোনা ভাইরাস কীট আবিস্কার সহ প্রথিতযশা চিকিতসকদের অবদানের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।
শুধু অর্থ বা ব্যক্তিগত ভোগের জন্য কেউ ডাক্তারি পেশায় আসে না। আসে মানব সেবার ব্রত নিয়েই।
২০২০ এর করোনা মহামারীতে সম্মুখ যোদ্ধাদের কথা স্মরনে রাখতে। করোনা শহীদদের আদর্শকে অন্তরে গ্রহন করতে হবে সম্মানে, শ্রদ্ধায়, কর্মে।
দেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই আত্মত্যাগ ও অবদানের ইতিহাস যদি না জানে তাহলে ডা: রাকিবের মতন আরো অনেক মেধাবীদের এভাবেই ভবিষ্যতে জীবন দিতে হবে।
সকল বিদেহী আত্মার শান্তি হউক।
দূর হউক যত অন্ধকার, মংগলময় হউক জীবন। 
ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক
সেগুনবাগিচা, ঢাকা
বিষয়: ডা: মালিহা পারভীন

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: