গোয়েন্দা অপ্সরা ও রিসোর্ট কাণ্ড (পর্ব দুই) : আসিফ মেহ্দী
 প্রকাশিত: 
 ২৬ জুলাই ২০২১ ১৮:০৪
 আপডেট:
 ৪ আগস্ট ২০২১ ১৯:৪১
                                
আলিম সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর জ্যাকলিনকে কল দিল অপ্সরা। জ্যাকলিন জানাল, উত্তরা থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে যাওয়া তার জন্য সহজ হবে। সে আগেও দেশের ভেতরে প্লেনে যাতায়াত করেছে। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের জন্য যে ডমেস্টিক টার্মিনাল আছে, সেটি তার চেনা। এক ঘণ্টার মধ্যে জ্যাকলিন ওখানে পৌঁছে যাবে।
চপল অপ্সরাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপু, আমরা কি কক্সবাজারের তরঙ্গ ইকো রিসোর্টে যাচ্ছি?’
অপ্সরা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমাদের ফ্লাইট বারোটায়।’
চপল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘কী মজা, ফ্লাই করব! কখনো বিমানে চড়া হয়নি।’
অপ্সরা বলল, ‘তুমি কি ভেবেছ আমি চড়েছি! আমার জন্যও প্রথম অভিজ্ঞতা।’
চপল যেন উচ্ছ্বাস লুকাতেই পারছে না। বলল, ‘গোয়েন্দাগিরি যে এত মজার ব্যাপার, তা আগে বুঝিনি। গত কয়েকমাস ধরে তরঙ্গ ইকো রিসোর্টের খুব নাম শুনছি। সবাই রিসোর্টে ঘুরতে যাচ্ছে আর ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করছে। আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ওরাই করবে, তাই না?’
অপ্সরা বুঝতে পারছে, চপল বুদ্ধিদীপ্ত হলেও মাঝেমাঝে কথাবার্তায় শিশুসুলভ। অপ্সরা জবাব দিল, ‘তা তো অবশ্যই।’
চপল বলল, ‘দিনটা বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো! শুধু কক্সবাজারে যাওয়ার ব্যাপারটা আগে জানা থাকলে দুই সেট পোশাক, পেস্ট-ব্রাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে আসতাম।’
অপ্সরা বলল, ‘সমস্যা নেই। কক্সবাজারে গিয়ে শপিং করা যাবে।’
অপ্সরা গোছগাছে মন দিল। চপল চার্জার বের করে মোবাইল সেট চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। সোয়া দশটার দিকে অপ্সরার মোবাইলে রিং বেজে উঠল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আলিম সাহেবের গাড়ির ড্রাইভার জানাল যে অফিসের বাইরে গাড়িসহ সে অপেক্ষা করছে। বেগুনি রঙের ব্যাগটি নিয়ে অপ্সরা রওনা হলো। চপলের কাঁধে স্কুলব্যাগ। আপাতত এগুলোই তাদের ট্রাভেলিংয়ের সঙ্গী। চপল পুরো ব্যাপারটিতে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর অপ্সরাকে চিন্তিত মনে হলো। এবারের কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ; সেইসঙ্গে দায়্ত্বিপূর্ণ তো বটেই। রিসোর্টের সুনাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইছে কোনো গোষ্ঠী; তা থেকে ইকো রিসোর্টটিকে বাঁচাতে হবে।
বেলা এগারোটায় এয়ারপোর্টের ডমেস্টিক টার্মিনালে পৌঁছল অপ্সরাদের গাড়ি। সেখানে আগেই পৌঁছে অপেক্ষা করছে জ্যাকলিন। মিরপুরে গাড়িতে ওঠার সময়ই ড্রাইভার একটি খাম অপ্সরার হাতে দিয়েছিল। তাতে আছে তিনজনের বিমান টিকিট এবং দশ হাজার টাকা। অপ্সরা একটি টিকিট নিজে রেখে বাকি দুটো জ্যাকলিন ও চপলকে দিল।
ডমেস্টিক ফ্লাইটে ওঠার ফরমালিটিজ কম। গোয়েন্দা টিম বিশ মিনিটের মধ্যে সব সেরে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসল। অপ্সরা জ্যাকলিন ও চপলকে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জ্যাকলিন, চপল আমাদের টিমে নতুন যোগ দিয়েছে। বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর চপল, ও জ্যাকলিন। ওর কথাই সকালে বলছিলাম। মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।’
জ্যাকলিন বলল, ‘ভাইয়া, আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ছেন?’
‘ট্রিপল ই-তে।’
‘আমার এক কাজিন বুয়েটে পড়েন মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টে।’
‘ও, আচ্ছা।’ চপল আর কী বলবে, খুঁজে না পেয়ে চুপ থাকল।
অপ্সরা বলল, ‘জ্যাকলিন, এবারের কেসটা সম্পর্কে তুমি এখনো জানো না। আলিম ভাইয়ার সঙ্গে আমার যে কনভারসেশন হয়েছে, সেটা তোমার জন্য আমি রেকর্ড করে রেখেছি। একটু শুনে দেখো।’
জ্যাকলিন সম্পূর্ণ কথোপকথনটি শুনল। তারপর আর কথা বলার সময় থাকল না। বোর্ডিং শুরু হয়ে গেল। ঠিক বারোটায় প্লেন উড়ল কক্সবাজারের উদ্দেশে। জীবনে প্রথমবারের মতো বিমানে ভ্রমণ করে চপল উচ্ছ্বসিত। প্লেনে নাশতা হিসেবে স্যান্ডউইচ, বিস্কুট আর জুসের ব্যবস্থা চপলের উচ্ছ্বাস আরও বাড়িয়ে তুলল। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটে অপ্সরা ও তার টিম পৌঁছল কক্সবাজার এয়ারপোর্টে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে ঢাকার গোয়েন্দা টিমের জন্য অপেক্ষা করছে নকুল সাহেবের পাঠানো সাদা মাইক্রোবাস। বিমানে ওঠার আগেই অপ্সরাকে এসএমএস করে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছিলেন আলিম সাহেব; সঙ্গে দিয়েছিলেন নকুল সাহেব ও মাইক্রোবাসটির ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর। তাই মাইক্রো খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। সবাই সাদা গাড়িটিতে ওঠার পর তা রওনা দিল ইকো রিসোর্টের উদ্দেশে। এমন ভ্রমণে কে-ই বা ক্লান্ত হয়; রহস্য উন্মোচনের জন্য তিনজন গোয়েন্দাই বেশ চাঙ্গা হয়ে আছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে তরঙ্গ ইকো রিসোর্টে পৌঁছতে চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগল। গোয়েন্দা টিম প্লেনে বসেই ঠিক করেছিল যে নকুল সাহেব ছাড়া অন্য কারও সামনে রিসোর্টের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবে না। কারণ, রিসোর্টের অভ্যন্তরীণ যে কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তাই মাইক্রোবাসে ড্রাইভার থাকায় অপ্সরা ও তার টিম চুপচাপ আশপাশের প্রকৃতি উপভোগ করতে থাকল। রিসোর্টে প্রবেশ করতেই তিনজনের চোখ জুড়িয়ে গেল। অনিন্দ্য সবুজ প্রকৃতি, প্রবেশমুখে অনেকটা জায়গাজুড়ে বাহারি ফুলের বাগান, বিভিন্ন দিকে কাঠের-ছনের কুঁড়েঘর, পরিপাটি বিশাল একটি ডাইনিং হলও দেখা যাচ্ছে, দূরে বাঁশের সাঁকো, তারপর বালুপূর্ণ সৈকত, উত্তাল সমুদ্র-কী নেই! চপলের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে ভীষণ আনন্দিত। অন্য দুই গোয়েন্দার মুখ দেখে বোঝা না গেলেও তাদের মনও প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন হয়েছে।
গাড়ি থেকে নামার সঙ্গেসঙ্গে পরিপাটি পোশাকের দুজন কর্মচারী অপ্সরাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল ফুলের তোড়া দিয়ে। তাদেরকে নিয়ে গেল ম্যানেজারের অতিথিদের জন্য গড়া ওয়েটিং রুমে। বাইরে কড়া রোদ থাকলেও ওয়েটিং রুমের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আছে। একজন ট্রে-তে করে পানীয় দিয়ে গেল। প্রত্যেকের সামনে দিল দুটো বড় কাচের গ্লাস-একটিতে ডাবের পানি ও অন্যটিতে বরফ কুচি দেওয়া পেঁপের শরবত। গোয়েন্দা টিমের প্রাণ জুড়িয়ে এল।
অপ্সরা, চপল ও জ্যাকলিন তিনজন তিনটি বেতের চেয়ারে বসেছে। চেয়ারগুলোর পাশে একটি বুকশেলফে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ রাখা। চপল একটি বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। জ্যাকলিন চারপাশে তাকিয়ে দেখতে থাকল। একটি সাইড টেবিলে অনেকগুলো ম্যাগাজিন রাখা। ম্যাগাজিনগুলো হাতে তুলে নিল অপ্সরা। সেগুলোর নিচে একটি খাতা দেখে খাতাটি হাতে নিয়ে ম্যাগাজিনগুলো রেখে দিল। খাতার ভেতরে অসংখ্য পেপার কাটিং। এই রিসোর্ট সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় যে প্রতিবেদনগুলো ছাপা হয়েছে, সেগুলোর কাটপিস খাতাটিতে আঠা দিয়ে লাগানো রয়েছে। খাতাটি উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকল অপ্সরা।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দশ মিনিটের মধ্যে নকুল সাহেব এলেন। বিশালদেহী, ক্লিন শেভড, লম্বা নাক ও লম্বাটে মুখের এক ভদ্রলোক। হাতে ল্যাপটপ। টি-টেবিলে ল্যাপটপ রেখে বেতের লম্বা সোফাটিতে বসতে বসতে বললেন, ‘তা এখানে আসতে কোনো ট্রাবল হয়নি তো?’
চপল বলল, ‘না, একদমই সমস্যা হয়নি। ভিআইপি মর্যাদায় যেভাবে এই রিসোর্টে এলাম…’
চপলের কথা শেষ হওয়ার আগেই নকুল সাহেব বললেন, ‘তা তো অবশ্যই। আপনারা আমার অনারেবল গেস্ট। আলিমের সঙ্গে ঘটনাটা শেয়ার করতেই আপনাদের সম্পর্কে ইনফরমড হলাম। এমন প্রুডেন্ট গোয়েন্দাদল থাকতে আমার টেনশন কী?’
পরিচয়পর্বে যেন সময়ক্ষেপণ না হয়, সেজন্য অপ্সরা সরাসরি তদন্ত সংক্রান্ত প্রশ্ন করে বসল, ‘আলিম ভাইয়ার কাছে শুনলাম, সকালে আপনার কাছে একটা চিঠি এসেছে। এ ঘটনায় আপনি কাউকে সন্দেহ করছেন?’
নকুল সাহেব বললেন, ‘স্পেসিফিক কাউকে না। তবে ডেফিনিটলি ভেতরের কেউ ইনভলভড। কারণ বাইরে থেকে কেউ এসে এই রিসোর্টে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে যাবে, এমন সুযোগ নেই। ইন্টার্নাল কেউ না কেউ জড়িত আছে।’
জ্যাকলিন বলল, ‘রিসোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু বলুন।’
নকুল সাহেব বললেন, ‘রিসোর্টের মেইন গেটে রোস্টারের মাধ্যমে সবসময় দুজন সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তাছাড়া রিসোর্টজুড়ে ইনস্টল করা সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজর রাখার জন্য দুজন ডেডিকেটেড ছেলে আছে। আমার পাশের রুমেই বসে। রিসোর্টে কর্মচারী ও গেস্ট ছাড়া অন্য কেউ ঢুকল কিনা, আনওয়ান্টেড কিছু ঘটল কিনা-এসব দেখাই তাদের কাজ। প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও বিকাল-এই তিন টাইমে তারা আমাকে আপডেট দেয়। আপনারা আসার আগে আমি তাদের সঙ্গে বসে বিগত কয়েকদিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখছিলাম। লাস্ট উইকে কর্মচারী ও গেস্ট ছাড়া কেউ ঢোকেনি।’
অপ্সরা বলল, ‘চিঠিটা কি একটু দেখতে পারি?’
নকুল সাহেব বললেন, ‘অবশ্যই। চিঠি সঙ্গে করেই নিয়ে এনেছি।’
অপ্সরা চিঠিটি হাতে নিয়ে চপলকে দিল জোরে পড়ার জন্য। চপল জোরে চিঠির লেখাগুলো পড়ল:
‘নকুল, চিনতে পেরেছিস? তোর স্কুলফ্রেন্ড খগেন। রিসোর্টে তো বেশ কামাচ্ছিস! সবার মুখে খুব নাম। কিন্তু এসব কী হচ্ছে বল তো? অতিথিদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের গোপন ভিডিও করার ব্যবসা ফাঁদলি কবে? প্রমাণ হিসেবে পেনড্রাইভে গতরাতের একটি ভিডিও দিলাম। গোপন ক্যামেরায় এসব ধারণ করছিস, মানুষ জানলে তোকে জানে রাখবে না। কিন্তু আমাকে থামালে সহজেই পার পাবি। মাত্র দশ লক্ষ টাকা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে নিচের নম্বরে যোগাযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। খুব সামান্য তোর জন্য। কক্সবাজার শহরেই আছে আমার লোক। তবে পুলিশকে জানালে ভিডিওটা ভাইরাল হতে আধঘণ্টাও লাগবে না। স্কুলের গুডবয় তুই। গুডবয়ের মতো টাকাটা দিয়ে দিলেই মুশকিল মিটে যাবে।
মোবাইল: ০১XXX৭৯XXXX’
চলবে
আসিফ মেহ্দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী
বিষয়: আসিফ মেহদী

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: