বধির নিরবধি (পর্ব ১) : আসিফ মেহ্দী
 প্রকাশিত: 
 ২৪ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৭
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১১:৪৬
ইনা কখনো এতটা ভড়কায়নি। আজ ভীষণভাবে ভড়কে গেছে। তার প্রিয় দাদাজান ভোরবেলায় খুব সাবলীল ভঙ্গিতে ভড়কানোর কাজটি করেছেন। তিনি ইনাকে মোবাইলে কল দিয়ে রুমে যেতে বললেন। একই বাসায় থাকেন ইনার দাদা শওকত সাহেব। শওকত সাহেবের রুমেই ঘটল ভড়কানিপর্ব। তবে সেখানে যাওয়ার আগে ঘটেছে আরেক বিব্রতকর ঘটনা। এত ভোরে নিজের রুম থেকে বের হয়েই মাকে দেখে ভূত দেখার মতো চেঁচিয়ে উঠেছে ইনা। আপন মা-কে দেখে ভয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলে সম্মানের শুধু ফালুদা না; আলুপুরী তৈরি হয়ে যায়। ইনার সম্মানের আলুপুরী তৈরি হয়েছে পাঁচসকালে (ভোর পাঁচটাকে সাতসকাল বলা ঠিক না)।
বিপদ ও দুর্ভাগ্য যখন আসে, একা আসে না। হেঁচকির মতো একটার পর একটা আসতেই থাকে। ইনার তারস্বরে চিৎকারে অট্টালিকার সবার ঘুম ভেঙে গেল। একজনের পর একজন হাজির হতে থাকল ঘটনাস্থলে। এমনকি নিচতলার ভাড়াটিয়া চরম আঁতেল ছেলে ছানোয়ারও চোখ ডলতে ডলতে হাজির। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভোরেই ঘুমিয়েছিল বেচারা। শুধু আসেনি ওপরতলায় থাকা ইনার চাচার পরিবার। সমাজেও দেখা যায়, ওপরতলার মানুষরা বিপদে-দুর্ভাগ্যে খুব একটা সাড়া দেয় না। যাহোক, ঘটনা বেশি প্যাচ খায়নি। নিজের মমতাময়ী মা-কে দেখে সন্তানের চমকে ওঠায় সবাই কিছুটা হলেও হতভম্ব; তবে ঘুমের ঘোরে থাকায় কেউ কথা না বাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল। দাদাজানের রহস্যজনক ফোনকল পেয়ে ইনা অন্যমনস্কভাবে রুম থেকে বের হয়েছিল। ধারণা ছিল না, এত ভোরে তার মা নিঃশব্দে বাসার মধ্যে চলাচল করছে। ফলাফল-মাকে দেখে একমাত্র কন্যার হাউমাউ চিৎকার!
সারাদিন সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ইনার মা দিলারা। সহজ-সরল মানুষটি মেয়ের ভয় কাটাতে তাকে কাছে টেনে নিয়ে একপশলা থুতু থেরাপি দিলেন। দিলারা সমস্ত অ্যানার্জি দিয়ে থুতু ছিটিয়েছেন মেয়ের বুকে যাতে ভয় কেটে যায়। অন্যদিকে, থুতুতে ইনার অ্যালার্জি। বিরক্ত হলেও মা-কে এড়ানো সম্ভব হয়নি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও থুতুকে সাদরে বরণ করতে হয়েছে। তবে ভাগ্যে যা ঘটে, ভালোর জন্যই ঘটে। এই ক্ষুদ্র ভড়কানি ইনার প্রয়োজন ছিল। তা নাহলে দাদাজানের রুমে গিয়ে বৃহৎ ভড়কানি হজম করা তার জন্য কষ্টকর হতো।
শওকত সাহেবকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তার বর্তমান বয়স পঁচাত্তর। সুঠাম শরীর, মসৃণ চামড়া। দেখে মনে হয়, একটি দাঁতও পড়েনি। চোখে লাগেনি চশমা। এসব অর্জন অবশ্য এমনিতে আসেনি। সারাজীবন পরিশ্রম ও বিশ্রাম করেছেন নিয়ম মেনে। খাদ্যাভাস আর হাঁটার অভ্যাস ছিল মাপামাপা। কিন্তু রুমে ঢুকে ইজিচেয়ারে শওকত সাহেবকে অন্যরকমভাবে ও অন্যমনস্কভাবে বসে থাকতে দেখে ইনার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। দাদাজানকে এমন অবস্থায় ইনা আগে দেখেনি। শওকত সাহেব আড্ডাবাজি-গল্পগুজব পছন্দ করলেও কখনো হালকা রসিকতা করেন না কিংবা নিজেকে খেলো করে তুলতে পারে, এমন কিছু বলেন না। আশ্চর্যজনকভাবে, আজ তিনি তা-ই করলেন! ইনাকে এমন কিছু করার অনুরোধ করলেন, যা ইনা কল্পনাও করেনি। দাদাজানের সঙ্গে তার অনুরোধের বিষয়টি মোটেই মানাচ্ছে না।
শওকত সাহেব কথা শুরুই করলেন হালকা রসিকতার মাধ্যমে, ‘একটু আগে যে কাণ্ড ঘটিয়েছিস, তাতে শুভ সকাল বলা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছি না।’
‘তুমি কি ঘরে বসেই সব শুনতে পাচ্ছিলে?’
‘চিরকালই আমার শ্রবণশক্তি একটু তীক্ষ্মরে। সেসব থাক দাদু, তোকে একটা গোপন কাজ করতে হবে আমার জন্য। পারবি?’
‘গোপন কাজ!’
‘শুধু গোপন বললে ভুল হবে; অত্যন্ত গোপন। তুই ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে পারছি না। গত কদিন ধরে দুঃস্বপ্ন দেখছি। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। মাঝেমাঝে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে আমার সময় শেষের পথে।’
‘ছিঃ দাদাজান, সকালবেলায় এসব কী অলক্ষুণে কথা বলছ?’
‘প্রকৃতির খেয়ালই বলা চলে! আমি আজ অব্দি বেঁচে আছি সম্ভবত এই ওয়াদা রাখার জন্যই।’
‘কীসের ওয়াদা?’
‘সবকিছু বলার জন্যই তোকে ডাকলাম রে, দাদু। কথা দে, আমার জন্য কাজটা তুই করবি। এমন কিছু বলব না যা তোর সামর্থ্যের বাইরে; তবে কিছুটা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে।’
‘দাদাজান, বাচ্চা মানুষের মতো কী শুরু করলে বলো তো? চ্যালেঞ্জিং কাজ শুনে তো আমি আরও আগ্রহ পাচ্ছি! ভার্সিটির টার্ম ফাইনাল শেষ হওয়ার পর থেকে বোর সময় কাটাচ্ছি। আর কাজের ব্যাপারে যেহেতু তুমি আমার ওপর ভরসা করেছ, অবশ্যই করব। কাজের জন্য নিশ্চয়ই উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাব!’
পারিশ্রমিকের কথা রসিকতা হিসেবেই বলল ইনা। কিন্তু হালকা মেজাজে কথা বললেও শওকত সাহেব আজকে বেশ সিরিয়াস। তিনি বললেন, ‘অবশ্যই। কাজ শেষ হওয়ামাত্র পারিশ্রমিক পাবি। এমন পারিশ্রমিক দেব যে তুই খুশি হবি। তবে কাজের কথা বলার আগে দুটো শর্ত বলে নিতে চাই।’
ইনা কখনো তার দাদাজানকে এভাবে কথা বলতে দেখেনি। শওকত সাহেব সবসময় একটু ভারিক্কি চালেই কথা বলেন। আজকের কথাগুলো সেই তুলনায় হালকা ধাঁচের। শর্তের কথা শুনে ইনা মৃদু হেসে বলল, ‘সকালে এসব কী শুরু করলে, দাদাজান?’
‘যা করছি, সিরিয়াসলি করছি দাদু। এসব ঠাট্টা ভাবিস না আবার।’
‘আচ্ছা, ঠাট্টা ভাবছি না। তবে প্লিজ ভূমিকা বাদ দিয়ে বলো তো সিরিয়াস বিষয়টা কী?’
‘শর্ত দুটো শুনবি না?’
‘বলো, কী শর্ত?’
‘প্রথম শর্ত, গোপন কাজের ব্যাপারটা তুই এই বাসার কারও সঙ্গে শেয়ার করবি না। পাকা কথা দিতে হবে।’
ইনা মনেমনে ভড়কাল। কী এমন ব্যাপার যে পরিবারের কারও সঙ্গেই শেয়ার করা যাবে না! এই তিনতলা ‘শ্রাবণী ভিলা’তে শওকত সাহেবের দুই ছেলে পরিবার নিয়ে থাকে। দিদা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। তারপর থেকে ছেলেরাই তার দেখভাল করছে। দাদাজান তাদের কাছ থেকেই কিছু লুকাতে চাচ্ছেন! প্রথমে ভড়কে গেলেও ইনা ভেবে দেখল, লুকানোতে দোষের কিছু নেই; কেউ কোনো বিষয়ে প্রাইভেসি পছন্দ করতেই পারেন। ইনা কিছুটা খুশিও হলো এই ভেবে, যে কথা কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চান না দাদাজান, সেই কথা তিনি তার কাছে বলতে চান। আনন্দে ইনার নিজেকে ভিভিআইপি মনে হচ্ছে! খুশিমনে সে বলল, ‘পাকা কথা দিলাম, দাদাজান।’
‘গুড। দ্বিতীয় শর্তটা হলো, আমি যতটুকু বলব, তার বেশি কিছু তুই জানতে চাইবি না।’
ইনা এবার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, জানতে চাইব না। এখন বলো তো, ব্যাপারটা কী?’
শওকত সাহেব ইনাকে কাজটি বুঝিয়ে দিলেন। বিস্তারিত শোনার সময় ইনার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। আতংকে না; উত্তেজনায়। এমন রোমাঞ্চকর কাজের কথা ইনা কল্পনাও করেনি। ভীষণ অবাকও হয়েছে। সর্বশেষ এমন অবাক হয়েছিল জন্মদিনে শোভনের দেওয়া উপহার দেখে। গিফটের সুন্দর মোড়ক খুলতেই বেরিয়ে পড়েছিল হলুদ রঙের জীবন্ত টিকটিকি! জন্ম থেকেই টিকটিকি সহ্য করতে পারে না ইনা। কারণটা অদ্ভুত-টিকটিকি দেখতে ‘গু’-এর মতো; তাছাড়া সিলিংয়ে এমনভাবে লেপটে থাকে যে মনে হয় টুপ করে এখনই গায়ে পড়বে!
ইনা নিজের ঘরে ঢুকে একপাশের দেয়ালে ঝুলানো আয়নার দিকে তাকাল। দাদাজানের দেওয়া কাজটির বর্ণনা শুনে সে এতটাই বিস্মিত যে তার মুখ থেকে বিস্ময়ভাবের রেশ এখনো কাটেনি। জীবনে চলার পথে জনৈক প্রিয় আগন্তুক কোনো এক স্বপ্নীল ক্ষণে ইনাকে জানিয়েছিল, বিস্মিত হলে তাকে কতটা সুন্দর লাগে-চোখে গভীরতা ভর করে, হাসিতে রহস্যের ছাপ পড়ে, উজ্জ্বল ফর্সা গালে গোলাপি আভা ফুটে ওঠে! সেই বাণী অমোচনীয় কালির মতো আজও ইনার হৃদয়ের আবরণে লেপটে আছে।
আয়নায় নিজের দিকে মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইনা। তারপর টেবিল থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে শোভনকে কল দিল। যথারীতি ইনার কথা কিছু না শুনে নিজেই হড়বড় করে কথা বলতে থাকল শোভন। শোভনের কথা টম অ্যান্ড জেরির দৌড়ের মতো চলতেই থাকে, ‘দোয়া কোরো ইনা, আজ আমার পরীক্ষা। নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট জমা দিতে যাচ্ছি। এখন নাটক মানেই প্রেম-পিরীতি-ছ্যাঁকা-পরকীয়া। এসব ধারণা থেকে উঠে আসতে পারছে না কেউ। তাই আমিই লিখে ফেললাম ভিন্নধারার নাটক। নাটকের নাম, “পাশের বাসার ভাবীর দুধ-চা খেয়ে বিড়াল প্রেগনেন্ট”! কী নেই এতে? সাসপেন্স, রোমান্স, কমেডি, ট্রাজেডি,...’
ইনা বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিল। বলল, ‘অ্যাই, কী নাম বললে! এটা কোনো নাটকের নাম হলো?’
‘কেন হতে পারবে না! এটাই আমাদের সমস্যা-একটা টাইপের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। সেই গণ্ডির বাইরেও যে চিন্তা করা যায়, সেটা আমরা বুঝতে চাই না। কিছু নবীন প্রতিভাবান লেখক এটা বুঝতে পেরেছেন। তাইতো এক ছোটভাই তার নতুন উপন্যাসের নাম দিয়েছেন, “দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব”! চিন্তা করে দেখো, কী ক্রিয়েটিভিটি ভাইটার।’
‘তোমার এই নাটক কোনো চ্যানেল নেবে বলে আমার মনে হয় না।’
‘এভাবে বোলো না, ইনা। ইতিমধ্যে “জান চ্যানেলে” স্ক্রিপ্ট ই-মেইল করে পাঠিয়েছি। তারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হয়েছে; তা না হলে তো ডেকে পাঠানোর কথা না। দোয়া কোরো আমার জন্য। এটা না হলেও আমার লেখা আরেকটা নাটক রেডি আছে। সেটা সামাজিক। নাটকের নাম, “শুভ বিবাহ নিয়ে এ কী ভয়াবহ কাণ্ড-দেখুন ভিডিওসহ”। নিজের লেখা বলে বলতে পারছি না যে ফাটাফাটি কনসেপ্ট! এক নিপাট ভদ্রলোকের জীবনকাহিনি। কনেদেখার সময় ছোটবোনকে দেখিয়ে তার বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয় বড়বোনের সঙ্গে। সামান্য ঘোমটার সহযোগিতায় ঘটানো হয় এই ঐতিহাসিক ঘটনা। ভদ্রলোক ষড়যন্ত্র টের পান যখন সব শেষ অর্থাৎ বাসরঘরে। অবশ্য, গিরিঙ্গি শুরু বাসরঘরেই...’
‘তুমি থামবে। ছিঃছিঃ। তোমাকে একশ একটা ছিঃছিঃ। কী লিখেছ এসব!’
‘তুমি বাস্তবতাকে ছিঃছিঃ বলছ ইনা! এটা তো বানানো কাহিনি না। সত্য। ফ্যাক্ট। চিরনির্যাতিত ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার আমি নিজে নিয়েছি। সত্য ঘটনার আলোকে লেখা; শুধু এতদিন এই ঘটনা আলোর মুখ দেখেনি। সেই বড়বোনের সঙ্গেই ভদ্রলোক ছত্রিশ বছর ধরে সংসার করছেন! ছত্রিশ বছরের কাহিনি দিয়ে আমি ছত্রিশ পর্বের নাটক লিখতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। বেশি পর্বের নাটকে কাহিনি ঝুলে যায়। নাটক হবে কনডেন্সড মিল্ক এর মতো। ঘটনার ঘনঘটা থাকা চাই। আমার নাটক দেখলে দর্শক কনডেন্সড মিল্ক এর স্বাদ পাবে।’
‘উফ, আমার মাথা ধরে গেছে। আমি রাখছি।’ বলে ইনা কল কেটে দিল। ইদানিং ইনা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে, শোভনের চিন্তা-কথা-কাজের ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে তার মন-মানসিকতার সিনক্রোনাইজেশন ঠিকমতো হচ্ছে না। বছরখানেক আগে শোভনের সঙ্গে হঠাৎ পরিচয়। ইনার বান্ধবী মোহনার ছোটভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা। তখন শোভন কিছুদিন আসল রূপে ছিল না। ইনার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে নিজস্ব সত্ত্বা হারিয়েছিল। ভেড়া হয়ে ইনার মন যেমনটা চাইত; কীভাবে যেন তেমনটাই হয়ে থাকত। ইনার অল্প মনখারাপেই পারলে ভ্যা করে কেঁদে দিত। সেসময়ে শোভনের কথাগুলো ইনার মনে ধরত; সারপ্রাইজগুলো অন্তর ছুঁয়ে যেত। তাই ইনাও ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে ছিল। কিন্তু সেই মোহ এত দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে, ইনা ভাবেনি।
একজন মানুষ কতকাল নিজের আসল রূপ লুকিয়ে রাখতে পারে! সময়ের সঙ্গেসঙ্গে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে শোভনের প্রকৃত সত্ত্বা। আজ ইনার খুব ইচ্ছা করছিল, খানিকক্ষণ কথা বলে শোভনকে ভিডিওকল দেবে। বিস্মিত ইনার রূপ দেখে হয়তো শোভন বিস্মিত হবে! কিন্তু শোভনের সঙ্গে ‘হঠাৎ পরিচয়’-এর মতো ইনার ইচ্ছাটি ‘হঠাৎ মরে-পচে-গলে’ গেল।
ইনা আয়নার দিকে আরেকবার তাকাল। মুখে যে বিস্ময়ভাব ছিল, তা উবে গেছে। কল কেটে দেওয়ার পর শোভন যথারীতি আর কলব্যাক করার প্রয়োজন বোধ করেনি। হয়তো কল কেটে দেওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। ছেলেটা অদ্ভুত এক মোহাচ্ছন্নতায় নিজেকে আটকে ফেলছে। ইনা এসব ভেবে সময় নষ্ট করতে চায় না। আজ অনেক কাজ। সন্ধ্যার পর এলাকার মুরব্বিরা আসবেন বাসায়। তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করতে হবে। তবে তার আগে নিজেকে একটু সুস্থির করা দরকার।
ইনার রুমে বিশেষভাবে তৈরি বড় একটি জানালা আছে। জানালাজুড়ে দুটো স্লাইডিং কাঁচ দেওয়া। নিরাপত্তার জন্য কাঁচের ওপাশে গ্রিল লাগানো। উইন্ডো-সিট এর আদলে জানালার পাশের মেঝে খানিকটা উঁচু করে বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। জানালার কাঁচ ছুঁয়েছে বসার জায়গাটি। বাসার এ অংশটিকে ইনা বলে ‘বাতায়ন-আসন’। প্রায়ই দোতলার বাতায়ন আসনে বসে রাস্তার কোলাহল ও জীবনের প্রবাহ দেখে ইনা। জীবন ও জীবিকার চঞ্চলতা তাকে করে শান্ত ও স্থির।
বাতায়ন-আসনে বসল ইনা। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। সকালেও থামেনি। শ্রাবণের বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে ইনাদের তিনতলা বাসার সামনের রাস্তায় বেশ পানি জমে গেছে। তারপরও থেমে নেই মানুষের জীবন; বরং পানি জমে যাওয়ার কারণে যানজট লেগে আছে। শতশত রিকশা-গাড়ি ধীরেধীরে এগিয়ে চলেছে। কতশত কথা-কলরব শোনা যাচ্ছে। ইনার ভীষণ ভালো লাগছে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এই আবহ দেখতে। বৃষ্টি হলে ইনার খানিক উদাস-উদাসও লাগে। পিঠাপিঠি বড় রনি ভাইয়া সুন্দর একটি হেডফোন দিয়েছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে ইনা গান শুনতে থাকল আর নিচে প্রবহমান জীবনতরঙ্গের দিকে তাকিয়ে রইল। তার কানে বেজে চলেছে-
“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন,
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।”
আসিফ মেহ্দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী
বিষয়: আসিফ মেহদী

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: