গোয়েন্দা অপ্সরা ও ধাঁধাল পত্র (পর্ব দুই) : আসিফ মেহ্দী
 প্রকাশিত: 
 ২৪ মে ২০২১ ২১:০৫
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১১:৪৬
                                
অপ্সরাদের আসার খবর আলিম চৌধুরী গেটে বলে রেখেছিলেন। এ কারণেই দারোয়ান সোজা ভেতরে চলে যেতে বলল। বাড়িটির সামনে বেশ খানিকটা জায়গা। সেখানে কিছু ফুলের গাছ লাগানো; তবে তেমন বাহারি কোনো ফুল নেই। একজন মালি নিড়ানি দিয়ে ঘাস কাটছে। আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখে অপ্সরা মনেমনে খুশি হলো। কারণ, তার অনুমানের সঙ্গে মিলে গেছে। ভদ্রলোকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর, শুদ্ধ উচ্চারণ, সুমিষ্ট কথা ও কিঞ্চিৎ পরিচয় জেনে অপ্সরা ধারণা করেছিল, এমন একটি বাড়ির অধিকারী তিনি। বাড়ির ভেতরের দিকটায় কালো রঙের একটি প্রাডো জিপের দরজা খুলে বসে আছে ড্রাইভার। দূর থেকে মনে হচ্ছে, রেডিও শুনছে।
অপ্সরা ও জ্যাকলিন দরজায় কলবেল চাপতেই এক তরুণ এসে দরজা খুলে দিল। বলল, ‘আপনারা সোফাতে বসুন, ম্যাডাম। আমি স্যারকে খবর দিচ্ছি।’
দরজা দিকে ঢুকলে কিছুদূর সামনে সোফাসেট রাখা। অপ্সরা ও জ্যাকলিন ড্রইংরুমের সোফাতে বসল। অ্যাসিস্ট্যান্ট টাইপের তরুণটি ড্রইংরুম দিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। নিচতলায় ভেতরের দিকে আরও রুম আছে। রান্নাঘরও সেদিকে। রান্নার ঘ্রাণ আসছে। বেশ কয়েকজনের কথাবার্তার মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে। তারা ভেতরের রুমগুলোতে এবং রান্নাঘরে কাজ করছে। ড্রইংরুমের একপাশে অর্থাৎ সোফাটির পেছনদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। অপ্সরা সোফা থেকে উঠে পুরো ড্রইংরুম ঘুরে দেখতে থাকল। জ্যাকলিন সোফার একপাশে রাখা ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকল। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এক ছেলে চা-নাশতা দিয়ে গেল।
আলিম চৌধুরী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন প্রায় আধঘণ্টা পর। বললেন, ‘দুঃখিত, দেরি হয়ে গেল। আসলে তোমরা আসবে বলে আজ বাসা থেকেই অফিস সারছি। কিন্তু একটা অনলাইন মিটিংয়ে জরুরিভাবে বসতে হলো। বিদেশি ক্লায়েন্ট। তাই হুট করে না করতে পারিনি।’
অপ্সরা বলল, ‘দেরিতে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। ওর নাম জ্যাকলিন। আমাকে সহযোগিতা করছে।’
‘ভালো লাগল দুজন গোয়েন্দার দেখা পেয়ে।’
অপ্সরা ও জ্যাকলিন বসেছে বড় সোফায়। আলিম চৌধুরী বসলেন অন্য একটি সোফায়। গোলগাল ভরাট মুখে মোটা গোঁফ আর পুরু জুলফি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খুব যত্ন করে চুল আঁচড়ানো। মাথাভর্তি কালো চুল দেখে প্রথম দেখায় যেকেউ তার বয়স ভেবে বসবেন চল্লিশের ঘরে। কিন্তু তার দেওয়া তথ্যমতে, বয়স পঁয়ষট্টি। আলিম সাহেব বললেন, ‘পেপারে পাত্র চাই বিজ্ঞাপনের জায়গায় রহস্য চাই বিজ্ঞাপন দেখে আমি আর দেরি করিনি। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, এমন কাউকেই গত কদিন ধরে আমি মনেমনে খুঁজছিলাম। তা আমিই বুঝি তোমাদের ফার্স্ট ক্লায়েন্ট?’
‘জি।’ অপ্সরা হাসিমুখে বলল।
‘তোমাদের তুমি করেই বললাম। কারণ, আমি তোমাদের দুজনের বাবার বয়েসি।’
‘অবশ্যই।’ বলল অপ্সরা।
আলিম সাহেব খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘তোমাদেরকে আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটি ঘটনা বলতে চাই, যা আগে কারও সঙ্গে শেয়ার করিনি।’
অপ্সরা বলল, ‘ঘটনাটি যে আর কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি, তা আমি কিন্তু আগেই বুঝতে পেরেছি।’
‘কীভাবে?’ কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন আলিম সাহেব।
‘দেয়ালে টাঙানো সবগুলো ছবিই আপনার! ফ্যামিলি থাকলে অন্তত একটি ছবি তাদের থাকত।’
‘ব্যস, এটুকুই?’
‘না, আরও অনেক ব্যাপারই আছে। তবে আপনি মন খারাপ না করলে বলতে পারি।’
‘না, না, এতে মন খারাপের কী আছে?’
‘আপনার বাড়িতে আভিজাত্য আছে কিন্তু মায়ার ছোঁয়া নেই সেসবে। ঘরে সহধর্মিনী থাকলে এমনটা হয় না। ক্রোকারিজ সেটগুলোর কাছে গেলে বোঝা যায়, ধুলোর আস্তরণ জমে গেছে। বইয়ের শেলফে উঁকি দিয়ে দেখলাম, মাকড়সা জাল গড়েছে। এত বড় বড় সোফা অথচ ফুলদানি নেই। বাইরের বাগানে সুন্দর-সুন্দর ফুলের গাছ থাকতে পারত, তাও নেই। ব্যাচেলরদের বাসার গোছানো সংস্করণ বলা যেতে পারে আপনার বাসা। ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করার জন্য পরিবার নেই আপনার; অ্যাম আই রাইট?’
অপ্সরা স্পটভাষী হয়ে উঠেছে। অন্য কেউ হলে তার কথার স্টাইলে হয়তো মনে কিছুটা কষ্ট পেত কিন্তু আলিম সাহেব তেমন নন। নিজের অনুভূতির ওপর ভীষণরকম নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই তিনি একজন সফল ইনডাস্ট্রিয়ালিস্ট। তার পুরু গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘আমি ইমপ্রেসড, অপ্সরা। আমার বাবা মারা যান ঠিক আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার আগে। এটি আমার জীবনের প্রথম বড় ধাক্কা। দ্বিতীয় বড় ধাক্কাটি পেয়েছি যখন ভালোবাসার মানুষের পরিবার আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি। সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার কারণ…’
ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার আগেই জ্যাকলিন বলল, ‘সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার কারণ আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা।’
আলিম সাহেবকে এবার কিছুটা বিব্রত মনে হলো। তিনি আশপাশে একবার চোখ বোলালেন; যেন দেখলেন কেউ শুনে ফেলল কিনা। তিনি হয়তো অন্য কোনো বানানো কারণ বলতেন কিন্তু জ্যাকলিন সত্যটা ধরে ফেলায় প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘আহা খেয়ালই করিনি, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেল।’
‘অসুবিধা নেই। পরে চা খাওয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে। তবে আমার প্রিয় একটা ডেজার্ট তোমাদের খেতেই হবে। দিলখুশ পান। মুখে দিলে মনে হয় জিভের জলে গলে যাবে। প্রথম খেয়েছিলাম একটা বড় রেস্টুরেন্টে। পরে ওই রেস্টুরেন্টে যে পান বানায়, তাকে নিয়ে এসে বাসার গৃহপরিচারিকাদের ট্রেনিং দিয়েছি। সবগুলো উপাদানই বাসায় মজুত করা আছে। প্রতিদিন একবেলায় দিলখুশ পান খাই। এ বাসায় মেহমান আসে না বললেই চলে। অফিসের কাজ বাসায় করলে মাঝেসাঝে অফিসের লোকজন আসে। তখন দিলখুশ পান দিয়ে আপ্যায়ন করানো হয়। তোমাদেরকে দিলখুশ পান খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
অপ্সরা বলল, ‘নিমন্ত্রণ কবুল করলাম, ভাইয়া। পানের বর্ণনা শুনে তো বেশ লাগছে!’
আলিম সাহেব গলা বাড়িয়ে ম্যানেজার ছেলেটিকে ডাকলেন। তার অফিসরুমে দিলখুশ পান দিতে বললেন। তারপর অপ্সরাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ম্যানেজার হিসেবে ওকে রেখেছি মাস দুয়েক হলো। একা পেরে উঠছিলাম না। চলো দোতলায় যাই। সেখানেই আমার ঘরোয়া অফিসরুম।’
আলিম সাহেব খোলা ড্রইংরুমে ব্যক্তিগত বিষয়টি বলতে সংকোচ বোধ করছেন, অপ্সরা ব্যাপারটি ধরতে পেরেছে। বাসাটির নিচতলায় চারপাশের ভেতরের ঘরগুলোতে কয়েকজন গৃহপরিচারক কাজে ব্যস্ত। আলিম সাহেবের ঘরোয়া অফিসরুমে যাওয়ার জন্য তার পিছু নিল অপ্সরা ও জ্যাকলিন। দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের আচরণ স্বাভাবিক; তবে যে কাজটির জন্য তিনি ডেকেছেন, তা ততটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না দুজনের। রহস্যজালে যেহেতু তারা নিজেদের আটকেছে, তা ছিন্ন করেই তাদের ফিরতে হবে।
আলিম সাহেবের বাসার ভেতরের অফিসরুমটিও অফিসের আদলে গড়া। একটি টেবিলের ওপাশে বসলেন তিনি। অপরপাশে বসল অপ্সরা ও জ্যাকলিন। আলিম সাহেব বলা শুরু করলেন, ‘ডাক্তার আর গোয়েন্দাদের কাছে কিছু গোপন করলে নিজেরই ক্ষতি। তোমরা ঠিকই ধরেছ, আমি অকৃতদার। তবে অবাক হয়েছি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তোমাদের কথা শুনে। কোথাও এটি আমি উল্লেখ করিনি। এখানে আসার আগে আমার সম্পর্কে কি কারও কাছ থেকে তথ্য নিয়েছ?’
জ্যাকলিন হাসিমুখে বলল, ‘না, আমি ধারণা করেছি।’
‘ধারণা করেছ!’
‘জি। এইচএসসি পরীক্ষার আগে আপনার বাবা মারা যান। এমন অবস্থায় পড়া কোনো পরিবারের ছেলেমেয়ের জন্য পড়াশুনায় আর বেশিদূর এগোনো সত্যিই দুরূহ। তাই গেস করলাম।’
আলিম সাহেব মুখ থেকে বিব্রতভাবটি উবে গেল। জ্যাকলিনের ব্যাখ্যায় তিনি খুশি হলেন। বললেন, ‘সবসময় অফিসে যাই না। তখন এটি আমার অফিসরুম।’
অপ্সরা বলল, ‘কাজের জন্য সুন্দর পরিবেশ।’
জ্যাকলিন বলল, ‘এবারে আপনার গল্পটি শুনতে চাই।’
আলিম সাহেব শুরু করলেন, ‘আমি মূলত একজনকে ভালোবেসেছি জীবনে। এতটাই ভালোবেসেছি যে অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু আমার প্রিয় মানুষটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য একজনের সঙ্গে। তবে বিয়ের আগে সে আমাকে বলেছিল, প্রতি বছর একটি বিশেষ দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমরা কোথাও বসে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলব। সত্যি সত্যিই এভাবে গত বিয়াল্লিশ বছর আমাদের দেখা হয়েছে!’
অপ্সরা বলল, ‘তার নামটি কি জানতে পারি?’
আলিম সাহেব বললেন, ‘ওর নাম মিথি। প্রতিবছর আমাদের দেখা হয় একটু ভিন্ন উপায়ে। নির্দিষ্ট দিনটির দশ-বারোদিন আগে আমার ঠিকানায় একটি চিঠি আসে। কিন্তু সেটি প্রেমপত্র না। সেখানে লেখা থাকে ধাঁধাল বাক্য। তা থেকে আমাকে খুঁজে বের করতে হয় সাক্ষাতের স্থান। তারপর নির্দিষ্ট দিনে সুনির্দিষ্ট সময়ে আমি সেই স্থানে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করি।’
‘ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
আলিম সাহেব বড় করে দম নিলেন। বললেন, ‘এই প্রথমবারের মতো আমি আটকে গেছি। সেকারণেই তোমাদেরকে এখানে ডাকা। এবারের চিঠির অর্থ আমি এখনো উদ্ধার করতে পারিনি। চিঠির মর্মোদ্ধারের জন্য আজসহ মাত্র তিনদিন বাকি। সকালে পেপারে তোমাদের বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো তোমরাই আমাকে সহযোগিতা করতে পারো। আর বুঝতেই পারছ, আমি ব্যবসায়ী মানুষ। পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য পাবে।’ এটুকু বলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি খাম বের করে অপ্সরার হাতে দিলেন আলিম সাহেব।
অপ্সরা খামটি দেখতে যাবে, ঠিক তখনই কিশোর ছেলেটি ট্রে-তে সুন্দর করে সাজিয়ে তিনটি পান নিয়ে এল। ট্রে টেবিলে রেখে চলে গেল। আলিম সাহেব বললেন, ‘নাও, আগে দিলখুশ পান খেয়ে দেখো।’
তিনজনই পান মুখে দিলেন। পান খাওয়ার সময় সবাই চুপ। মুখে পান ঢুকিয়ে কথা বলা মুশকিল, হয়তো এটিই কারণ। খাওয়া শেষে আলিম সাহেব বললেন, ‘কেমন লাগল পান?’
অপ্সরা বলল, ‘অসাম! এমন পান আমি আগে কখনো খাইনি!’
জ্যাকলিন বলল, ‘একদমই অন্যরকম! খুব ভালো। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ওয়েলকাম।’ বললেন আলিম সাহেব।
অপ্সরা খামটি হাতে ধরল। জ্যাকলিনও সেদিকে চোখ দিল। খামের ওপর প্রেরকের স্থানে লেখা- আলিমা, কলাবাগান, ঢাকা। শেষে একটি মোবাইল নম্বরও আছে। অপ্সরা বলল, ‘এখানে তো দেখছি নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সবই আছে। একটা কল দিলেই মনে হয় প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে।’
আলিম সাহেব রহস্যের হাসি হেসে বললেন, ‘আসলে নামটা আমার নামের সঙ্গে মিল রেখে অন্য একটি নাম লেখা। কলাবাগানে মিথির বাসা, এটা সত্যি। কিন্তু কলাবাগানের কোথায়, তা আমার জানা নেই। ইন ফ্যাক্ট, মিথিও আমার বাসার ঠিকানা পুরোপুরি জানে না। আমরা আমাদের কিছু বিষয়ে প্রাইভেসি রেখেছি দুজনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। তাছাড়া মোবাইল নম্বরটি ওর হলেও সবসময় বন্ধ থাকে। সিমটি আমিই ওকে দিয়েছিলাম। কুরিয়ারে দিতে হয় বলে এই নম্বর ব্যবহার করে।’
অপ্সরা খাম থেকে চিঠি বের করল। চিঠির ভাঁজ খুলে দেখল তাতে লেখা শুধু দুটো লাইন,
সম্মার্জন ক্রয়ের স্থান,
করো অর্জন পত্র একখান।
চলবে
বিষয়: আসিফ মেহদী

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: